মাল্টিডাইমেনশন ডেস্ক :
রাষ্ট্রপতি ইমানুয়েল ম্যাক্রোঁর দ্বিতীয় মেয়াদে তার কর্মসূচীর পরিকল্পনা অনুযায়ী পেনশন সংস্কার বিলটি ১০ জানুয়ারী ২০২৩ উপস্থাপন করা হয়েছে। সরকার ঘোষণা করেছে যে আইনী অবসরের বয়স ৬২ থেকে ৬৪ বছর করা হবে যাতে অন্যান্য ইউরোপীয় দেশের সাথে ভারসাম্য বজায় থাকে। উদাহরণস্বরূপ, জার্মানিতে বর্তমান অবসরের বয়স হল ৬৫ বছর এবং ৭ মাস। সংস্কারের পিছনে প্রধান যুক্তি হল দীর্ঘায়ু বার্ধক্য জনসংখ্যার বৃদ্ধি যা পেনশন তহবিলের উপর চাপ বাড়াচ্ছে এবং প্রয়োজনীয় সংস্কারের অভাবে এই তহবিল ভবিষ্যতে শুকিয়ে যাবে।
অবসরের বয়স প্রতি বছর ৩ মাস হ্রাস পাবে, সেই হিসাবে ইমানুয়েল ম্যাক্রোঁর পাঁচ বছরের মেয়াদ শেষে ৬৩ বছরে এবং ২০৩০ সালে ৬৪ বছরে পৌঁছাবে। প্রধানমন্ত্রী এলিজাবেথ বোর্নের হিসেবে ২০২৭ সাল থেকে সম্পূর্ণ পেনশন পেতে হলে একজনকে ৪৩ বছর কাজ করতে হবে বা ১৭২ টি ত্রৈমাসিক আর্থিক অবদান করতে হবে।
আর যারা ৪৩ বছর ধরে আর্থিক অবদান করতে পারবেন না, তাদের জন্য পূর্ণ অবসরের বয়স (ছাড় ছাড়া) ৬৭ থাকবে।
এছাড়াও প্রতিশ্রুতি অনুযায়ী ন্যূনতম পেনশনের হার SMIC (ন্যূনতম বেতন)-এর ৮৫% করা হবে, তাতে মাসিক পেনশন ১০০€ বেড়ে ১২০০€ হবে। যেহেতু এই সংস্কারটি SMIC-এর ভিত্তিতে করা হয়েছে, পেনশনের পরিমান SMIC-এর মতো একই সময়ে বৃদ্ধি পাবে। নতুন এবং পুরানো উভয় পেনশনভোগীরা এই পুনর্মূল্যায়নের মাধ্যমে উপকৃত হবেন।
বিদ্যমান বিভিন্ন পেনশন স্কিম বন্ধ করে দেওয়া হবে এবং সরকার পয়েন্টের ভিত্তিতে একটি সার্বজনীন পেনশন ব্যবস্থা স্থাপন করবে। নতুন নিয়োগপ্রাপ্তরা সাধারণ পেনশন স্কিমের সাথে যুক্ত হবেন।
যারা তাড়াতাড়ি কাজ শুরু করেছেন তারা আগেই অবসর নিতে পারবেন। উদাহরণস্বরূপ, যারা ১৬ বছর বয়সের আগে কাজ শুরু করেছিলেন তারা ৫৮ বছর বয়সে অবসর নেবেন, যারা ১৮ বছর বয়সে কাজ শুরু করেছেন তারা ৬০ বছর বয়সে অবসর নেবেন এবং যারা ২০ বছরের আগে কাজ শুরু করেছেন তারা ৬২ বছর বয়সে অবসর নেবেন।
এছাড়াও, এই সংস্কারটি কঠিন কাজ, ভারী ভার বহন এবং অন্যান্য বিষয়গুলিকে বিবেচনা করবে, যা পেশাদার পুনঃপ্রশিক্ষণের জন্য ছুটির অর্থায়ন থেকে উপকৃত হবে।
সরকারি কর্মচারী এবং সক্রিয় বিভাগ কার্যরত যেমন নার্স, দমকল বা স্বাস্থ্য সহকারীদের জন্য প্রাথমিক অবসর প্রথা বজায় রাখা হবে।
কর্মক্ষেত্রে দুর্ঘটনা বা পেশাগত রোগের শিকার ব্যক্তিরা ৬০ বছর বয়সে অক্ষমতার কারণে অবসর নিতে পারবেন (প্রাথমিক খসড়ায় যা ৬২ বছর করা হয়েছিল)। প্রতিবন্ধী কর্মীরা ৫৫ বছর বয়স থেকে অবসর নিতে পারবেন।
এই সংস্কারটি খুবই বিতর্কিত কারণ এটি উপলভ্য চাকরির সংখ্যা হ্রাসের দিকে নিয়ে যাবে, বিশেষ করে তরুণদের জন্য, এবং যারা ইতিমধ্যে বেকার তাদের জন্য চাকরির নিরাপত্তাহীনতা তৈরি করবে এবং লিঙ্গ বৈষম্যকে শক্তিশালী করবে। আমরা জানি যে মহিলাদের প্রায়শই একটি বিচ্ছিন্ন কেরিয়ার থাকে, তাই তাদের সম্পূর্ণ অবসরের সুবিধাগুলি পেতে আরও বেশি সময় কাজ করতে হবে। তবে নারীরা যেহেতু পুরুষদের সমান বেতন পান না, তাদের অবসরকালীন পেনশনও কম হবে।
এই সংস্কার যারা সবচেয়ে অনিশ্চিত অবস্থায় রয়েছে, যারা তাড়াতাড়ি কাজ শুরু করেছে এবং যাদের আয়ু বাকি জনসংখ্যার চেয়ে কম তাদের অবস্থা আরও খারাপ করবে।
১৯ জানুয়ারী, এই সংস্কারের বিরুদ্ধে প্রথম জাতীয় ধর্মঘট সংঘটিত হয়েছিল যা পরবর্তীতে জানুয়ারী, ফেব্রুয়ারি এবং মার্চ মাস জুড়ে চলমান। সমস্ত সমীক্ষা অনুসারে এই সংস্কারটি বিশেষভাবে অজনপ্রিয় এবং প্রায় ৭০% জনসংখ্যা এর বিরুদ্ধে।
গত ১৬ মার্চ, সেনেটে (সংসদের উচ্চকক্ষ) ডানপন্থী (রিপাবলিকান এবং মধ্যপন্থী) এবং ম্যাক্রোনিস্ট সংখ্যাগরিষ্ঠদের মধ্যে কয়েকটি বিষয়ে ঐকমত্যের ভিত্তিতে, যেমন, দীর্ঘ কর্মজীবন, ৬০ বছর বা তার চেয়ে বেশি বয়সী কর্মচারীদের নিয়োগের জন্য একটি কর্মজীবনের শেষ চুক্তি তৈরি করা (সিডিআই সিনিয়র), পরিবারের দায়িত্বে থাকা মায়েদের জন্য প্রিমিয়াম ইত্যাদি, সংস্কার বিলটি পাস হয়। ১৯৩টি ভোট পড়ে পক্ষে ও ১১৪টি ভোট বিপক্ষে।
যেহেতু সরকার জাতীয় পরিষদে (সংসদের নিম্নকক্ষ) সংস্কারের পক্ষে ভোটের সংখ্যা সম্পর্কে নিশ্চিত নয়, তাই নির্বাচিত জনপ্রতিনিধি (আইনপ্রণেতা)-দের ভোটের পরিবর্তে সংবিধানের ৪৯.৩ অনুচ্ছেদ ব্যবহার করে সংস্কার বিল পাস করার ঘোষণা দিয়েছে।
গণতন্ত্রের নীতির পরিপন্থী এই খবরে ফরাসি জনগণ ক্ষুব্ধ । ফলস্বরূপ, ১৬ মার্চ বৃহস্পতিবারের হরতাল, যা একটি শান্তিপূর্ণ ধর্মঘট হিসাবে শুরু হয়েছিল, তার অবনতি ঘটে। বিক্ষোভকারীরা প্যারিসের রাস্তায় আবর্জনার ক্যান উল্টে দেওয়া এবং বেশ কিছু গাড়ি পুড়িয়ে দেওয়ার মতো হিংসাত্বক কাজে লিপ্ত হয়। পুলিশ বিক্ষোভকারীদের থামানোর চেষ্টা করে এবং ২০০ জনেরও বেশি লোককে গ্রেপ্তার করা হয়। শ্রমিক ইউনিয়নগুলো মানুষকে আরও সংঘবদ্ধ হওয়ার আহ্বান জানিয়েছে।
সংস্কারের বিরুদ্ধে ধর্মঘট, সেইসাথে পরিবহন ও আবর্জনা সংগ্রহকারীদের ধর্মঘট পরের দিনও অব্যাহত ছিল।
১৭ মার্চ, সরকারকে তার সিদ্ধান্ত থেকে পেছোতে বাধ্য করতে দুটি অনাস্থা প্রস্তাব গ্রহণ করা হয়েছে, যার মধ্যে প্রথমটি লিবার্তে, আন্দেপঁন্দ, উথ্র-মের এ তেরেতোয়ার (LIOT) গ্রুপের দ্বারা উত্থাপিত ‘ট্রান্সপার্টিজান’ অর্থাৎ দলীয় সম্পর্কমুক্ত, এবং দ্বিতীয়টি রাসেম্বলমঁ ন্যাশনাল (মেরিন লে পেনের পার্টি) দ্বারা উত্থাপিত। ২০ মার্চ সোমবার বিকাল ৪টায় জাতীয় সংসদে এই প্রস্তাব দুটি অধ্যয়ন করা হবে। যদি অনাস্থা প্রস্তাব দুটি আইনপ্রণেতাদের নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠ ভোট, অর্থাৎ ২৮৭টি ভোট না পায়, সেক্ষেত্রে বিলটি ভোট ছাড়াই নিশ্চিতভাবে গৃহীত হিসাবে বিবেচিত হবে।
রিপাবলিকান দল (LR)-এর প্রেসিডেন্ট, এরিক স্যতি, ঘোষণা করেছেন যে তার দলের আইনপ্রণেতারা কোনো অনাস্থা প্রস্তাবের পক্ষে ভোট দেবেন না, আর সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জনের জন্য তার দলের অন্তত ত্রিশজনের ভোট প্রয়োজন।
রাসেম্বলমঁ ন্যাশনাল (RN)-এর সভাপতি জর্ডান বারডেলার মতে, এই অনাস্থা প্রস্তাব দুটি গৃহীত হওয়া সম্ভব যদি বিরোধীরা, অর্থাৎ NUPES (বাম দল এবং পরিবেশবিদদের জোট, যার মধ্যে জ্যঁ-লুক মেলেনশঁর ‘অদমনীয় ফ্রান্স’ অন্তর্ভুক্ত) এবং RN একসাথে আসে। “
এদিকে, ১৮ মার্চ, সংস্কারের বিরুদ্ধে আরেকটি বিক্ষোভ কার্যক্রম ঘোষণা করা হয় এবং ফ্রান্সের বিভিন্ন শহর যেমন নান্ত, ব্রেস্ট এবং বোর্দোতে উত্তেজনা ছড়িয়ে পড়ে। প্যারিসের কিছু কিছু এলাকা সমাবেশের জন্য বন্ধ ছিল এবং অনেক মেট্রো স্টেশন বন্ধ করে দেওয়া হয়েছিল। যদিও এই বিক্ষোভের আহ্বান আগের দিন সামাজিক নেটওয়ার্কগুলিতে দেয়া হয়েছিল।
বিলের বিরোধীরা আগামী বৃহস্পতিবার ২৩ মার্চ আরেকটি জাতীয় ধর্মঘট দিবসের ঘোষণা করেছে।
সর্বশেষ তথ্য:
সরকারের বিরুদ্ধে অনাস্থা প্রস্তাব দুটি প্রত্যাখ্যান হওয়ার পর সোমবার সন্ধ্যায় পেনশন সংস্কার স্বয়ংক্রিয়ভাবে গৃহীত হয়েছে।
ট্রান্সপার্টিসান অর্থাৎ দলীয় সম্পর্কমুক্ত অনাস্থা প্রস্তাবটি (LIOT) ২৭৮ জন জনপ্রতিনিধির ভোট পেয়েছে যা নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতার (২৮৭ ভোট) থেকে মাত্র নয়টি কম। অন্তত ২২ জন রিপাবলিকান আইনপ্রণেতা দলের সিদ্ধান্তকে অমান্য করে প্রস্তাবের পক্ষে ভোট দিয়েছেন।
পেনশন সংস্কার আটকানোর জন্য বিরোধীদের কাছে এখনও দুটি হাতিয়ার রয়েছে: একটি শেয়ার্ড ইনিশিয়েটিভ রেফারেন্ডাম (RIP) দাবি করা এবং সাংবিধানিক কাউন্সিল (Conseil d’Etat)-র কাছে আবেদন করা।
পেনশন বিল গৃহীত হওয়ার পরবর্তীতে সারা ফ্রান্স জুড়ে বিক্ষোভ ক্রমশ বাড়ছে। এপর্যন্ত সহিংসতা এবং বিক্ষোভকারীদের গ্রেপ্তারের অনেক ঘটনা ঘটেছে।
বুধবার দুপুর ১টায়, রাষ্ট্রপ্রধান ইমানুয়েল ম্যাক্রোঁ, TF1 এবং ফ্রান্স 2-তে ফরাসিদের উদ্দেশ্যে সরাসরি ভাষণ দেবেন।
Recent Comments